১৪ ফেব্রুয়ারি, লাল গোলাপ, চকলেট, আর হার্টের নকশায় সাজানো কার্ড—এই দিনটি সারা বিশ্বে “ভালোবাসা দিবস” হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু কীভাবে শুরু হয়েছিল এই রোমান্টিক উদযাপন? এর পেছনে লুকিয়ে আছে রোমান সাম্রাজ্যের রক্তাক্ত উৎসব, এক যাজকের গৌরবগাথা, এবং মধ্যযুগের কবিতার জাদু! চলুন, ভালোবাসা দিবসের অপ্রকাশিত ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক।

প্রাচীন রোমে লুপারকেলিয়া উৎসবের নৃশংসতা
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে রোমানরা লুপারকেলিয়া নামে একটি উৎসব পালন করত ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি। এটি ছিল প্রজনন ও উর্বরতার উৎসব, যার কিছু রীতি আজকের দিনে চিন্তা করলে গা শিউরে উঠবে।
এই উৎসবে পুরোহিতরা ছাগল বা কুকুর বলি দিয়ে তাদের চামড়ার ফালি দিয়ে নারীদের শরীরে আঘাত করতেন। বিশ্বাস ছিল, এতে নারীরা উর্বর হবে।
অন্যদিকে যুবকরা একটি বাক্স থেকে মহিলাদের নাম তুলতেন, এবং সারা বছর তারা একসাথে থাকতেন। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো পরিণত হত স্থায়ী সম্পর্কে।
সেন্ট ভ্যালেন্টাইন:

ভ্যালেন্টাইন নামটি এসেছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক এক খ্রিস্টান যাজকের জীবন থেকে। ৩য় শতাব্দীতে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস II সৈন্যদের বিয়ে নিষিদ্ধ করলে, ভ্যালেন্টাইন গোপনে তাদের বিয়ে দিতেন। ধরা পড়ার পর তাকে কারাগারে বন্দি করা হয়। অনেকের মতে কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি জেলের অন্ধ মেয়েকে একটি চিঠি লেখেন, যার শেষে স্বাক্ষর করেছিলেন “From Your Valentine”।
অতঃপর ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারির এই দিনে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরবর্তীতে খ্রিস্টান চার্চকে “প্রেমের পৃষ্ঠপোষক” হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
মধ্যযুগে চসারের কবিতা ও ভ্যালেন্টাইন কার্ড
“ফর উহিস ওয়াস শে অন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে, হোয়েন এভরি বার্ড কাম দেয়ার টু চুজ হিজ মেট।”
—জিওফ্রে চসার (১৩৮২)
১৪শ শতাব্দীতে ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার তার কবিতায় ১৪ ফেব্রুয়ারিকে পাখিদের প্রেমের দিন হিসেবে বর্ণনা করেন। পরবর্তীতে এই দিনটি ইউরোপে রোমান্সের দিন হিসাবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
হাতে লেখা কার্ড: ১৫শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় প্রেমিকরা হাতে আঁকা কার্ড বিনিময় শুরু করে। কার্ডে গোপনে ভালোবাসার কথা লিখতেন, যা “ভ্যালেন্টাইন” হিসেবে পরিচিতি পায়।
আধুনিক যুগে ভালোবাসা দিবস
১৯শ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ভ্যালেন্টাইন’স ডে পণ্য বিপণনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। ১৮৪৭ সালে সালে প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে ভ্যালেন্টাইন কার্ড বিক্রি শুরু করে এস্টার এ. হাওল্যান্ড। এরপর ১৯১৩ সালে হালমার্ক কার্ডের ব্যাপক উৎপাদন শুরু করে।
আপনি হয়তো বা বিশ্বাস করবেন না শুধুমাত্র ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে এই দিনটিতে ২৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যার মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই $৭ বিলিয়ন!
ভালোবাসা দিবসে বিভিন্ন প্রতীকগুলোর অর্থ:
❤️ লাল হার্ট: মধ্যযুগে হৃদয়কে আবেগের কেন্দ্র মনে করা হত।
🏹কিউপিড: রোমান মিথোলজির প্রেমের দেবতা, যার তীর- হৃদয়ে প্রেমের সৃষ্টি করে।
🌹 গোলাপ: গ্রীক দেবী অ্যাফ্রোডাইটের সাথে যুক্ত, লাল গোলাপ “আবেগের” প্রতীক।
বিশ্বজুড়ে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে যতসব রং বেরঙের রীতি
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৪ ফেব্রুয়ারিতে মেয়েরা ছেলেদের তাদের নিজেদের বাসায় স্পেশাল ভাবে তৈরি চকলেট দেয়। অপরদিকে ১৪ মার্চ (হোয়াইট ডে) ছেলেরা মেয়েদের সাদা চকলেট বা জুয়েলারি উপহার দেয়।
অন্যদিকে লাতিন আমেরনদিক দিনটিকে “ডía দে্ল আমোর ওয়াই লা অ্যামিস্তাড”(প্রেম ও বন্ধুত্বের দিন) হিসেবে পালন করা হয়। বন্ধু ও পরিবারকে উপহার দেওয়া হয়।
ভারত ও বাংলাদেশে যুগলরা এই দিনে রেস্টুরেন্ট ডিনার থেকে শুরু করে গিফ্ট বিনিময় করে। যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় #HappyValentinesDay ট্রেন্ড করা শুরু হয়।
ভালোবাসা দিবসের বাণিজ্য VS আবেগ
ভালোবাসা দিবসের আবেগ কে পেছনে রেখে সমালোচনাও কিন্তু কম নেই। অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে অনেকেই চাপ অনুভব করেন বিশেষ করে দামি উপহার কিনতে। এখনকার ভালবাসা কিছুটা বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। প্রিয় মানুষ কি গিফট করলো তা নিয়েই বরং বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
সাংস্কৃতিক বিরোধিতা:
অন্যদিকে ইরান, পাকিস্তান সহ বেশ কিছু দেশের কিছু গোষ্ঠী এটিকে “পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন” মনে করে।
অপরদিকে একা মানুষদের জন্য দিনটি বিষাদময় হয়ে ওঠে। অনেকে আবার এই দিনে একাকীত্ব ভোগেন।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে: প্রেমের রসায়ন
প্রেম শুধু আবেগ নয়, এর পেছনে কাজ করে মস্তিষ্কের রসায়ন! চলুন কিছু হরমোনের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
ডোপামিন: এই হরমোন সুখের অনুভূতি তৈরি করে (চকলেট খেলেও ডোপামিন বাড়ে!)।
অক্সিটোসিন: “আলিঙ্গন হরমোন” নামে পরিচিত, যা সম্পর্কে বিশ্বাস গড়ে তোলে।
সেরোটোনিন: মেজাজ স্থিতিশীল রাখে, প্রেমে পড়লে এর মাত্রা কমে যায় (যার কারণে প্রেমিক-প্রেমিকারা “পাগল” আচরণ করেন!)
তো যাইহোক ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস আমাদের শেখায়—প্রেমের রূপ বদলায় সময় ও সংস্কৃতির সাথে। তবে, এই দিনটি যেন শুধু বাণিজ্যিক উপলক্ষ যেন না হয়, বরং প্রতিদিন ভালোবাসা প্রকাশের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে।
“প্রেম কোনো দিন-তারিখের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়, তা হোক বছরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অগণিত মুহূর্তের সমষ্টি।”
এই লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয় মানুষের সাথে! কমেন্টে ভালোবাসা দিবস নিয়ে আপনার মতামত লিখুন। 💌
Leave a comment