ইউক্রেনের পর রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য কী? পুতিনের সুদূরপ্রসারী ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের গভীর বিশ্লেষণ

কল্পনা করুন, এক সকালে ঘুম ভেঙে আপনি শুনলেন রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের গভীরে প্রবেশ করেছে। তাদের যুদ্ধজাহাজ ও ট্যাংক ইউরোপীয় শহরগুলোতে বোমাবর্ষণ করছে, আর আর্কটিক ও কৃষ্ণ সাগরে মোতায়েনকৃত নৌ জাহাজগুলো থেকে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছে। আপনি কি তাহলে অবাক হবেন ? মনেকরুন রুশ সেনাবাহিনী ন্যাটোর প্রতিরোধ ভেঙে দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের সীমান্তে পৌঁছে গেছে। এটি কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, বরং এটিই সেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা যার ওপর ভ্লাদিমির পুতিন গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন। ইউক্রেন কেবল এই পরিকল্পনার প্রথম ধাপ। আসল প্রশ্ন হলো, রাশিয়ার প্রকৃত কৌশল কী এবং ইউক্রেনের পর রাশিয়া কী করতে চলেছে? পুতিনের তালিকায় পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু কে?

এই ব্লগ পোস্টে আমরা পুতিনের গোপন ভূ-রাজনৈতিক কৌশল বোঝার চেষ্টা করব এবং রাশিয়া এই মুহূর্তে কোন গোপন চাল চালার পরিকল্পনা করছে তা জানার চেষ্টা করব। ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়া এবং এর সম্ভাব্য ফলাফল থেকে শুরু করে রাশিয়ার সম্ভাব্য পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু, ন্যাটো জোটের ভবিষ্যৎ এবং বিশ্ব ব্যবস্থায় রাশিয়ার স্থান পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা – প্রতিটি বিষয় আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

ইউক্রেন যুদ্ধ কি দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের প্রথম ধাপ?

ইউক্রেন যুদ্ধ পঞ্চম বছরে পদার্পণ করেছে , কিন্তু এর শেষ কোথায় তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুতিন এই যুদ্ধকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চান, যাতে ইউক্রেন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির ওপর থেকে পশ্চিমা প্রভাব পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়। রাশিয়া এখন পর্যন্ত আমেরিকার সমস্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এর মূল কারণ হলো, পুতিন ইউক্রেনকে রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে একটি অপরিহার্য ‘বাফার জোন’ বা রক্ষাকবচ হিসেবে দেখেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তবে তা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য একটি বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই পুতিন এই যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে চান, যাতে তিনি ইউক্রেন এবং ন্যাটো উভয়কেই রাজনৈতিক, সামরিক এবং আর্থিকভাবে দুর্বল ও বিভক্ত করে ফেলতে পারেন। ইতোমধ্যেই এই দীর্ঘায়িত যুদ্ধ ন্যাটো দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বেশ প্রভাব ফেলছে, যা প্রকারান্তরে পুতিনের কৌশলকেই শক্তিশালী করছে।

মোটামুটি ভাবে ইউক্রেনে রাশিয়ার মূল লক্ষ্যগুলো চারটি ভাগে ভাগ করা যায়:

• ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদান থেকে বিরত রাখা।
• রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে একটি কৌশলগত দূরত্ব বজায় রাখা।
• ইউক্রেন থেকে পশ্চিমা রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব দূর করা।
• রুশভাষী জনগণের অধিকার রক্ষা এবং ক্রেমলিনের প্রতি অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করা (যদিও এটি বিতর্কিত)।

ইউক্রেনের পর পুতিনের সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু কারা?

ইউক্রেন যদি পুতিনের বৃহত্তর পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হয়ে থাকে, তাহলে পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু কারা হতে পারে? ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বেশ কয়েকটি দেশ রাশিয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হতে পারে।

মালদোভা: 

মালদোভাকে পূর্ব ইউরোপে প্রবেশের দরজা  বলা হয়ে থাকে। ইউক্রেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ছোট দেশ মালদোভা হতে পারে রাশিয়ার প্রথম লক্ষ্য। কৌশলগতভাবে মালদোভা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর সীমান্ত ন্যাটো সদস্য দেশ রোমানিয়ার সাথে যুক্ত। এখান থেকে রাশিয়া সহজেই পূর্ব ইউরোপের গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। কারণ হিসেবে বলা যায় মালদোভার বেশ কয়েকটি দুর্বল দিক রয়েছে। 

প্রথমত দেশটি অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বিভেদে জর্জরিত। দ্বিতীয়তঃ ট্রান্সনিস্ট্রিয়া, মালদোভার একটি অংশ ১৯৯০ সাল থেকে কার্যত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং সেখানে রুশ সৈন্য মোতায়েন করা আছে। রাশিয়া এই সৈন্যদের ব্যবহার করে সহজেই মালদোভা দখল করতে পারে। তৃতীয়ত কৌশলগত অবস্থান: মালদোভা দখল করলে রাশিয়া ইউক্রেনকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলতে পারবে এবং ইউক্রেনে যাওয়া পশ্চিমা সরবরাহের পথগুলো বন্ধ করে দিতে পারবে। মালদোভা দখল করা হলে, এই অঞ্চলে ন্যাটোর অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়বে এবং পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব বাড়বে।

বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ: 

একইভাবে, উত্তর দিকে রয়েছে ছোট ন্যাটো সদস্য দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া। এই দেশগুলোর সাথে রাশিয়ার সরাসরি সীমান্ত রয়েছে এবং এগুলোও রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।

এ সকল বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ রাশিয়ার খুব কাছে এবং আয়তনে ছোট হওয়ায় দেশগুলো সামরিকভাবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে এস্তোনিয়া ও লাটভিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক (প্রায় ২৫%) রুশভাষী মানুষ বাস করে, যাদের সাথে রাশিয়ার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। পুতিন এই রুশভাষীদের ‘সুরক্ষার’ অজুহাতে এখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারেন, যেমনটি তিনি ইউক্রেনের ক্ষেত্রে করেছিলেন।

যদি রাশিয়া এই দেশগুলোর কোনো একটিতে আক্রমণ করে, তবে তা হবে ন্যাটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি ‘আর্টিকেল ৫’-এর সরাসরি পরীক্ষা। এই নীতি অনুযায়ী, যেকোনো ন্যাটো সদস্য দেশের ওপর আক্রমণ জোটের সকল সদস্য দেশের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য হবে। কিন্তু বর্তমানে ন্যাটো দেশগুলোর মধ্যে বেশ বিভেদ তৈরি হয়েছে বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ন্যাটো এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সমালোচনা, যা জোটটির কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। যদি ন্যাটো সময়মতো এবং ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হয়, তবে জোটের বিশ্বাসযোগ্যতা শেষ হয়ে যাবে এবং এটিই হবে ন্যাটোর কার্যত সমাপ্তি। পুতিনের জন্য ন্যাটোকে এভাবে ভেঙে দেওয়া হবে এক বিশাল ভূ-রাজনৈতিক বিজয়।

জর্জিয়া: 

পুতিনের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে জর্জিয়া, ককেশাস অঞ্চলের একটি ছোট কিন্তু কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়ার ওপর একটি ছোট কিন্তু বিধ্বংসী আক্রমণ চালিয়েছিল, যার ফলে জর্জিয়ার দুটি অঞ্চল – আবখাজিয়া এবং দক্ষিণ ওসেটিয়া – কার্যত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং আজও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

যদিও জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগদানের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু এখনও সদস্য না হওয়ায় দেশটি বেশ অরক্ষিত। জর্জিয়ার অবস্থান এমন যে এটি ইউরোপ, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে একটি সংযোগস্থল বা প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে। গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি পাইপলাইন, যেমন বাকু-বিলিসি-সেহান (BTC) তেল পাইপলাইন এবং সাউথ ককেশাস গ্যাস পাইপলাইন, জর্জিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। এই পাইপলাইনগুলো কাস্পিয়ান সাগর থেকে তেল ও গ্যাস ইউরোপে পরিবহন করে। বর্তমানে এই পাইপলাইনগুলোর কারণে ইউরোপ রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের একটি বিকল্প পেয়েছে, যা মস্কোর উপর ইউরোপের নির্ভরতা কমিয়েছে।

রাশিয়া যদি জর্জিয়া পুরোপুরি দখল করে নেয়, তবে এই পাইপলাইনগুলো বন্ধ হয়ে যাবে যা ইউরোপকে তীব্র জ্বালানি সংকটে ফেলতে পারে। এর ফলে ইউরোপ আবারও রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তাই জর্জিয়ার দখল রাশিয়ার কাছে শুধু ভূমি দখলের চেয়েও বেশি কিছু – জ্বালানি সরবরাহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ইউরোপকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার একটি কৌশল। ইউরোপের অর্থনীতি যত দুর্বল হবে, ন্যাটোর মধ্যে বিভেদ তত বাড়বে এবং ভবিষ্যতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করা তাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

মধ্য এশিয়া: 

ইউরোপের পাশাপাশি মধ্য এশিয়া, বিশেষ করে কাজাখস্তান, রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজাখস্তান আয়তনের দিক থেকে বিশাল এবং তেল, গ্যাস, ইউরেনিয়াম ও রেয়ার আর্থ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। দেশটির সাথে রাশিয়ার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে কাজাখস্তান- রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি মস্কো থেকে কিছুটা দূরে সরে যাচ্ছে এবং নতুন সম্পর্ক খুঁজছে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) মাধ্যমে চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেছে। চীনের খরগোস গেটওয়ে (Khorgos Gateway) প্রকল্পটি কাজাখস্তানের মধ্য দিয়ে চীন ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য সংযোগ স্থাপন করেছে। চীন কাজাখস্তানে সড়ক, রেলপথ ও পাইপলাইনে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা এই অঞ্চলে বেইজিংয়ের প্রভাব বাড়াচ্ছে এবং রাশিয়ার উপর কাজাখস্তানের নির্ভরতা কমাচ্ছে।

তুরস্কও কাজাখস্তানের সাথে সামরিক চুক্তি ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ছে। কাজাখস্তান তুরস্ক থেকে নতুন অস্ত্র কিনছে, যার মধ্যে শক্তিশালী বেরাকতার টিবি-২ (Bayraktar TB-2) ড্রোনও রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোও কাজাখস্তানে তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে। শেভরন (Chevron) এবং এক্সনমোবিল (ExxonMobil) এর মতো আমেরিকান কোম্পানিগুলো কাজাখস্তানের বিশাল তেল ক্ষেত্র টেংগিজ (Tengiz) ও কাশাগানে (Kashagan) বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এর ফলে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদের ওপর রাশিয়ার প্রভাব কমছে। এছাড়াও, কাজাখস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সাথে যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করেছে, যা প্রমাণ করে যে দেশটি রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের বাইরে গিয়ে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

এই সকল পরিস্থিতি পুতিনের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তার মতে, কাজাখস্তান আর আগের মতো ‘নির্ভরযোগ্য’ মিত্র নয়। রাশিয়া কাজাখস্তানকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কূটনীতি, অর্থনৈতিক চাপ বা এমনকি প্রয়োজনে সামরিক হস্তক্ষেপও করতে পারে, কারণ কাজাখস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য মস্কোর কাছে অত্যন্ত জরুরি।

আর্কটিক অঞ্চল: 

বিশ্বের একেবারে উত্তরে, আর্কটিক অঞ্চলেও একটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। উত্তর মেরুতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরফ দ্রুত গলছে, যার ফলে নতুন সমুদ্রপথ খুলে যাচ্ছে। এই নতুন পথগুলো কেবল বিশ্ব বাণিজ্যের মানচিত্রই বদলে দেবে না, বরং সমুদ্রযাত্রাকেও অনেক সংক্ষিপ্ত করে তুলবে। উদাহরণস্বরূপ, জাপান থেকে পশ্চিম ইউরোপে যাওয়া একটি জাহাজ বর্তমানে সুয়েজ খালের মাধ্যমে প্রায় ১৩,০০০ মাইল ভ্রমণ করে। কিন্তু আর্কটিকের বরফ গলে গেলে, একই জাহাজ নর্দার্ন সি রুট (Northern Sea Route) বা নর্থওয়েস্ট প্যাসেজের (Northwest Passage) মাধ্যমে মাত্র ৭,০০০ মাইলের কাছাকাছি দূরত্বে পশ্চিম ইউরোপে পৌঁছাতে পারবে। এটি সময় এবং জাহাজ পরিবহন খরচ উভয়ই বাঁচাবে।

রাশিয়া এই নতুন সমুদ্রপথগুলোর গুরুত্ব খুব ভালোভাবেই বোঝে এবং তাই আর্কটিক অঞ্চলে দ্রুত নিজেদের পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া ইতিমধ্যেই আর্কটিক উপকূলরেখার অর্ধেকেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ এবং সেখানে ৫০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে। এছাড়া, রাশিয়ার ৪০টিরও বেশি বরফভাঙ্গা জাহাজ (আইসব্রেকার) রয়েছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে মাত্র দুটি কার্যকরী আইসব্রেকার (২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী)। 

রাশিয়া শুধু আইসব্রেকারেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আর্কটিক অঞ্চলে উন্নত রাডার ব্যবস্থা, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমনকি পারমাণবিক সাবমেরিনও মোতায়েন করেছে। এমনকি রাশিয়া আর্কটিকের সমুদ্রতলে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণেরও চেষ্টা করছে। এখানে বিলিয়ন ব্যারেল তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য রেয়ার আর্থ খনিজ পদার্থের বিশাল মজুদ রয়েছে। রাশিয়ার এই আগ্রাসী আর্কটিক কৌশলের জবাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে এবং প্রায় ৪০টি নতুন আইসব্রেকার তৈরির নির্দেশ দিয়েছে (যদিও এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য)। কিন্তু আমেরিকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আর্কটিকের অবকাঠামো এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পে তারা রাশিয়ার চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আইসব্রেকার তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন, ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ কাজ। আমেরিকা যদি অবিলম্বে কাজ শুরুও করে, রাশিয়ার সমপরিমাণ আইসব্রেকার তৈরি করতে তাদের বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে।

রাশিয়া আর্কটিকের নিয়ন্ত্রণ শুধু সম্পদের জন্য চায় না, বরং এর মাধ্যমে তারা পুরো বিশ্বের বাণিজ্য ও জাহাজ চলাচলের পথগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যদি ন্যাটো দুর্বল হয়ে পড়ে বা ভেঙে যায়, তবে আর্কটিকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া থেকে রাশিয়াকে কেউ আটকাতে পারবে না এবং এটি আগামী সময়ে মস্কোকে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক বড় খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

লিথিয়াম বিপ্লব ও নিষেধাজ্ঞামুক্ত অর্থনীতি

সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি, রাশিয়া নীরবে এমন কিছু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে যা আগামী বছরগুলোতে নিজেদের অর্থনীতিকে সচলরাখতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো লিথিয়ামের মজুদ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া।

রাশিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে লিথিয়ামের ব্যাপক উৎপাদন শুরু করতে চায়। তাদের লক্ষ্য প্রতি বছর কমপক্ষে ৬০,০০০ মেট্রিক টন লিথিয়াম কার্বোনেট উৎপাদন করা। এই পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বৈদ্যুতিক যানবাহন (EVs), সোলার ব্যাটারি এবং সবুজ জ্বালানি সমাধানের জন্য লিথিয়াম অপরিহার্য। আগামী সময়ে পুরো বিশ্বেই লিথিয়ামের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

বর্তমানে রাশিয়ার প্রায় ১ মিলিয়ন টন লিথিয়াম মজুদ রয়েছে, যার বেশিরভাগই সাইবেরিয়া এবং অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। পুতিন এই লিথিয়াম মজুদের সদ্ব্যবহার করে রাশিয়ার অর্থনীতিকে তেল ও গ্যাস রপ্তানির নির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে চান। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলো এই রপ্তানির উপর অনেক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

রাশিয়া যদি এই লিথিয়াম প্রকল্পে সফল হয়, তবে তারা বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে এবং তখন কোনো নিষেধাজ্ঞাই তাদের তেমন প্রভাবিত করতে পারবে না।

নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্য

রাশিয়ার এই সমস্ত পদক্ষেপ বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য – রাশিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের যুগের মতো আবারও একটি বিশ্ব পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। পুতিন প্রকাশ্যে বলেছেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং তখন থেকেই তিনি রাশিয়াকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পুতিন ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত রুশ সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী এবং সামরিক ক্ষেত্রে বাজেট ইউরোপের অনেক দেশের সম্মিলিত বাজেটের চেয়েও বেশি করেছেন। এরমধ্যেই যুদ্ধ চলাকালীন সময় জ্বালানি সরবরাহকে ব্যবহার করে ইউরোপের উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন।

পুতিনের আসল লক্ষ্য আরও বড়। তিনি এমন একটি বিশ্ব চান যেখানে বৈশ্বিক ক্ষমতা ও অর্থনীতি কোনো একটি দেশের (বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, বরং তা বহু দেশের মধ্যে বণ্টিত থাকবে – অর্থাৎ একটি বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা (Multipolar World Order) প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাশিয়া বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। যেমনঃ 

চীন: বর্তমানে রাশিয়া ও চীনের মৈত্রী সবচেয়ে শক্তিশালী। উভয় দেশেরই অভিন্ন লক্ষ্য হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য খর্ব করা। এই উদ্দেশ্যে রাশিয়া চীনকে অত্যন্ত কম দামে তেল ও গ্যাস সরবরাহ করছে। রাশিয়া ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং চীন এখন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উভয় দেশ মার্কিন ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রায় (রুবল ও ইউয়ান) বাণিজ্য করছে, যাতে ডলারের বৈশ্বিক প্রভাব দুর্বল করা যায়।

ইরান: বর্তমানে রাশিয়া ও ইরানের সম্পর্কও অত্যন্ত মজবুত হয়েছে। এই মৈত্রী বিশেষ করে সিরিয়া ও ইউক্রেনের মতো সংঘাত চলাকালীন সময়ে সামনে এসেছে, যেখানে ইরান রাশিয়াকে ড্রোন (যেমন শাহেদ-১৩৬) ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে, যা রাশিয়া এখনও ইউক্রেনে ব্যবহার করছে। বিনিময়ে রাশিয়া ইরানকে অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি দিচ্ছে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সাহায্য করছে। এই দুই দেশের জোট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং ইসরায়েলের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে উঠেছে।

ব্রিকস (BRICS) জোট: পুতিনের কৌশল শুধু চীন ও ইরানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ব্রিকস জোটের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা – এবং সম্প্রতি যোগ দেওয়া নতুন সদস্য দেশসমূহ) মাধ্যমে সেইসব দেশের সাথেও সম্পর্ক উন্নয়ন করছেন যারা আমেরিকা ও ইউরোপের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়ে বিরক্ত। ব্রিকস দেশগুলো বর্তমানে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে এবং বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৩০% নিয়ন্ত্রণ করে। এই জোট পশ্চিমা আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ) একটি শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।

ন্যাটোর চ্যালেঞ্জ ও পশ্চিমা বিশ্বের উভয়সঙ্কট

পুতিনের এই মহাপরিকল্পনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা বা প্রতিপক্ষ হলো ন্যাটো জোট। কিন্তু ন্যাটো বর্তমানে তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একসময়কার অত্যন্ত শক্তিশালী এই জোটের মধ্যে বর্তমানে ভালই বিভেদ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নেতারা ন্যাটোর কার্যকারিতা এবং সদস্য দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তৈরি করেছেন।

ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল সামরিক শক্তির মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ালেও তা রাশিয়ার সমকক্ষ হতে সময়সাপেক্ষ। যদি ন্যাটো ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারে, তবে পুতিনের পরিকল্পনা নির্ধারিত সময়ের আগেই বাস্তবে রূপ নিতে পারে। আর্টিকেল ৫-এর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় তৈরি হলে ছোট সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়বে, যা জোটকে ভেতর থেকেই দুর্বল করে দেবে।

বিশ্ব আজ এক যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। রাশিয়া তার হারানো প্রভাব পুনরুদ্ধারে এবং বিশ্ব ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজাতে এক বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশল অনুসরণ করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এই কৌশলের একটি অংশ মাত্র। মালদোভা, বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ, জর্জিয়া থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া ও আর্কটিক অঞ্চল – সর্বত্রই রাশিয়া তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। লিথিয়ামের মতো কৌশলগত সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং চীন, ইরান ও ব্রিকস দেশগুলোর সাথে জোটবদ্ধ হয়ে রাশিয়া পশ্চিমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

আগামী কয়েক বছরে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো আগামী বহু শতকের জন্য বিশ্ব ভূ-রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে। ইউরোপ কি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে, নাকি রাশিয়ার চাপে ভেঙে পড়বে? ন্যাটো কি তার বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে পারবে? রাশিয়া কি সত্যিই একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সফল হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের উপরই নির্ভর করছে বিশ্বের ভবিষ্যৎ। পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং পরিবর্তনশীল, এবং এর ফলাফল কী হবে তা কেবল সময়ই বলতে পারবে।