বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অপরাধীরা দিন দিন নতুন নতুন পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষকে ঠকানো, ছিনতাই ও শোষণের শিকার করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ একটি পদ্ধতি হলো “ডেভিলস ব্রেথ” বা “শয়তানের নিঃশ্বাস” নামক একপ্রকার রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা। এই ঔষধের প্রভাবে মানুষ মুহূর্তেই নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং অপরাধীদের কথামতো যেকোনো কাজ করতে বাধ্য হয়। আজকের এই ব্লগে আমরা জানবো স্কোপোলামাইন কীভাবে কাজ করে, এর হাত থেকে রক্ষা পেতে কী করণীয়, এবং বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর ইতিবাচক ব্যবহারের গল্প।
ডেভিলস ব্রেথ বা স্কোপোলামাইন কী?
স্কোপোলামাইন (Scopolamine) একটি শক্তিশালী অ্যান্টিকোলিনার্জিক ড্রাগ, যা প্রাকৃতিকভাবে Scopolia গাছের বীজ থেকে তৈরি হয়। এই ঔষধটি চিকিৎসাবিদ্যায় বমি নিয়ন্ত্রণ বা অ্যানেসথেসিয়ায় ব্যবহৃত হলেও, অপরাধীরা এর অপব্যবহার করে মানুষের স্নায়ুতন্ত্র অকার্যকর করে দেয়। বিভিন্ন ভিডিওতে বর্ণিত ঘটনায় দেখা যায়, অপরিচিত ব্যক্তি কোনো মানুষের মুখের কাছে একটি কাগজ বা বস্তু ধরে রাখে, যার মাধ্যমে স্কোপোলামাইন শ্বাসনালী বা ত্বকের সংস্পর্শে আসা শুরু করে। এর ফলে মুহূর্তেই মানুষটি নিজের সচেতনতা ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং অপরাধীর নির্দেশে টাকা-পয়সা, গয়না বা ফোন স্ব ইচ্ছায় বের করে দেয়।
কীভাবে কাজ করে স্কোপোলামাইন?
মানব মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার নামক রাসায়নিক পদার্থ স্নায়ুসংকেত প্রেরণে সাহায্য করে। এর মধ্যে এসিটাইলকোলাইন নামক নিউরোট্রান্সমিটার নতুন কিছু শেখা, সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং স্মৃতি ধরে রাখার জন্য অপরিহার্য। স্কোপোলামাইন সরাসরি মস্তিষ্কে প্রবেশ করে মাস্কারিনিক রিসেপ্টর ব্লক করে, যেখানে এসিটাইলকোলাইন সাধারণত যুক্ত হয়ে কাজ করে। ফলে:
সিদ্ধান্তহীনতা: ব্যক্তি কোনো যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
স্মৃতিশক্তি লোপ: ঘটনার পরবর্তী সময়ে কিছুই মনে রাখতে পারে না।
আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি: মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা অংশ প্রভাবিত হওয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায় ছিনতাইকারী বা অপরাধকারী কোন ব্যক্তির কাছে গিয়ে তাকে ফোনের মেসেজ বা প্রেসক্রিপশন পড়তে বলে, যার সাথে সাধারণত ড্রাগস মেশানো থাকে যা আপনার নাকের সংস্পর্শে আশার সাথে সাথে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে। এর ফলে আপনি সাময়িকভাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে পারেন অথচ আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার সাথে কিছু খারাপ হচ্ছে কিন্তু আপনি কোন প্রতিক্রিয়া বা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এক্ষেত্রে অপরাধীরা সাধারণত বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছ থেকে তাদের ফোন কিংবা টাকা পয়সা কিংবা কোন দামি জিনিস চেয়ে বসতে পারে আর আপনি ঠিক তার কথা মতোই কাজ করতে থাকবেন অর্থাৎ আপনার কাছে মনে হবে সে যা বলছে সেটাই সঠিক। এ অবস্থায় ব্যক্তিকে যদি নিজের ক্ষতি করতে বলা হয় তবে তিনি তাও করতে পারেন!
স্কোপোলামাইনের হাত থেকে রক্ষার উপায়
একা চলাফেরা এড়িয়ে চলুন:
মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় চলাচলের সময় সঙ্গী রাখুন। একাধিক ব্যক্তির উপর স্কোপোলামাইনের প্রভাব ফেলা অপরাধীদের জন্য একটু কঠিন।
মাস্ক ব্যবহার করুন:
মাস্ক পরলে শ্বাসের মাধ্যমে ড্রাগ প্রবেশের ঝুঁকি কমে। অপরিচিত কেউ কোনো কাগজ বা বস্তু দেখাতে এলে তা মুখ থেকে দূরে রাখুন।
অপরিচিত মানুষ হতে সতর্কতা:
কেউ প্রেসক্রিপশন পড়তে বা মেসেজ বুঝতে বললে, দূরত্ব বজায় রেখে সাহায্য করুন। সম্ভব হলে লোকসমাগমস্থলে (যেমন: ফার্মেসি বা দোকান) নিয়ে যান। এক্ষেত্রে কোনো কিছু স্পর্শ বা গ্রহণ করবেন না। স্কোপোলামাইন ত্বক দিয়েও শোষিত হতে পারে। অপরিচিত ব্যক্তির দেওয়া খাবার, নথিপত্র বা জিনিস ধরবেন না।
জরুরি চিকিৎসা:
কেউ ওভারডোজের শিকার হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিন। দীর্ঘমেয়াদী স্নায়বিক ক্ষতি এড়াতে অ্যান্টিডোট (যেমন: ফিজোস্টিগমাইন) প্রয়োজন।
কী ভূমিকা নিতে পারে রাষ্ট্র ও সমাজ?
– আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত স্কোপোলামাইন আমদানি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি করা।
– গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মিডিয়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্যাম্পেইন চালানো।
– হাসপাতালে জরুরি বিভাগে স্কোপোলামাইন আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া।
বিজ্ঞানে স্কোপোলামাইনের ইতিবাচক ব্যবহার
চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্কোপোলামাইনের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কগনিটিভ ডিসফাংশন গবেষণায় ইঁদুরের মডেলে এই ড্রাগ ব্যবহার করা হয়। নতুন ওষুধ পরীক্ষার আগে ইঁদুরের শরীরে ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মতো রোগ তৈরি করে স্কোপোলামাইন প্রয়োগ করে মেমোরি লস বা সিদ্ধান্তহীনতার মডেল বানানো হয়। এর মাধ্যমে ওষুধের কার্যকারিতা যাচাই করা সহজ হয়। এভাবে একটি ভয়ানক ড্রাগই মানবকল্যাণে অবদান রাখছে!
স্কোপোলামাইনের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে সচেতনতা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। অপরিচিত ব্যক্তি, অযাচিত সাহায্যের অনুরোধ বা রাস্তায় অদ্ভুত আচরণ—সবক্ষেত্রেই সতর্ক থাকুন। পাশাপাশি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও চিকিৎসকদের সমন্বিত উদ্যোগ এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মনে রাখবেন, “সতর্কতাই নিরাপত্তার প্রথম সোপান!
Leave a comment